চর্যাপদ কি—বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ।

চর্যাপদ কি

চর্যাপদের আবিষ্কার: বাংলা সহিত্যের একমত্র নির্ভরযোগ্য আদি নিদর্শন চর্যাপদ। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে রাজ দরবার থেকে এই নিদর্শন আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ’হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দেহা’ নামে প্রকাশ করা হয়। চর্যাপদের মোট পদসংখ্যা ৫১টি—পাওয়া গেছে সাড়ে ছেচল্লিশটি। একটি পদ খন্ডিত আকারে পাওয়া যায়; এবং আরও তিনটি পদ পাওয়া যায়নি বলে বলা হয়ে থাকে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে। চর্যাপদের পদকর্তা ২৩ জন মতান্তরে ২৪জন। চর্যাপদের আদি কবি লুইপা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের আদি কবি শবরপা। চর্যাপদের সর্বশ্রেষ্ঠ পদকর্তা কাহ্নপা এবং চর্যাপদের একমাত্র মহিলা কবি ‍কুক্কুরীপা।
চর্যাপদ কি
চর্যাপদ কি

চর্যাপদ কি

চর্যাপদের রচনাকাল:  চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত নানারকম মত ব্যক্ত করেন। ড. ‍সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে—চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০—১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
 সুকুমার সেন—চর্যাপদের কাল নির্ণয় করেন ৯০০-১২৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে—চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে শহীদুল্লাহ্ ও সুনীতি কুমারের মতগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য।

 

চর্যাপদের ভাষা: চর্যার ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ভারতীয় ভষাবিদেরা চর্যাপদকে তাঁদের নিজস্ব ভাষার নিদর্শন বলে দাবি করেন। তবে চর্যার আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ভাষার নিদর্শন বলে মত দেন। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যার ভাষাকে বাংলা ভাষার নিদর্শন হিসেবে প্রমাণ করেন। তিনি তাঁর ‘ODBL’ গ্রন্থে ব্যাকরণিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদিরূপে রচিত।

পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন চর্যার ভাষা সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা। তিনি মনে করেন—চর্যার ভাষা হচ্ছে আলো আঁধারির ভাষা। কথক আলো; কথক আঁধার; কিছু বোঝা যায়—কিছু বোঝা বড়ো দায়। যারা সাধন-ভজন করেন; তারাই মূলত এই ভাষা বুঝতে পারেন। সন্ধ্যা ভাষার আড়ালে বোদ্ধ সহজীয়ারা তাদের ধর্মের প্রচার করতো।

 পদকর্তা: চর্যার মোট পদকর্তা ২৩ জন মতান্তরে ২৪ জন। সর্বোচ্চ পদকর্তা কাহ্নপা পদ রচনা করেন ১৩টি; ভুসুকুপা পদ রচনা করেন ৮টি; সরহপা ৪টি; কুক্কুরীপা ৩টি; লুইপা, শান্তিপা, সবরপা ২টি করে পদ রচনা করেন এবং আর্যদেব, কঙ্কনপা, কম্বলাম্বর, গুণ্ডরীপা, চাটিলপা, জয়নন্দী, ডোম্বীপা, ডেন্টনপা, তন্ত্রীপা, তাড়কপা, দারিকপা, ধামপা, গুঞ্জরীপা, বিরুবাপা, বীনাপা, ভদ্রপা, মহীধরপা—ওঁরা প্রত্যেকে ১টি করে পদ রচনা করেন।

চর্যাপদ কি

চর্যাপদ কি ? চর্যাপদের পদগুলো…

চর্যাপদ ১।।লুইপাদ।

কাআ তরুবর পঞ্চ-বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই॥
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিতি লেহু রে পাস॥
ভণই লুই আম্‌হে ঝানে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পাণ্ডি বইঠা॥

 ব্যাখ্যা: শরীর হচ্ছে তরুর মতো এবং তার পাঁচটি ডাল রয়েছে। এই ব্যাকুলে হৃদয়ে কাল প্রবেশ করেছে। দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ করো। লুই বলেছেন, “কীভাবে মহাসুখ পরিমাণ করতে হবে তা গুরুর কাছে জেনে নাও। সমাধিতে থাকা অবস্থায় সাময়িক সময়ের জন্য দুঃখ থেকে দূরে থাকা যায়; কিন্তু সমাধি ভাঙলেই পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যেতে আসে। এড়িয়ে প্রসন্নচিত্তের আশা। লুই বলেছেন, আমি ধ্যান করার সময় দেখেছি; ধমন-চমণ দুই পিঁড়িতে আমি বসে আছি। (আরও দেখুন)

চর্য্যা ২।।কুক্কুরীপা।

দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ॥
আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী॥
সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানেট চোরে নিল কা গই  মাগঅ॥
দিবসই বহুড়ী কাড়ই ডরে ভাঅ।
রাতি ভইলে কামরু জাঅ॥
অইসনি চর্য্যা কুক্কুরীপাএ গাইউ।
কোড়ি মঝেঁ একু হিঅহিঁ সমাইউ॥

 ব্যাখ্যা: কাছিম দুটির পীঠ ধরা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল সব কুমিরে খায়। ঘরের মধ্যে আঙিনা, শোন ওগো অবধূতি। কানেট চোরে নিয়ে গেল, তা কোথায় গিয়ে সে চাইবে। দিনে যে বউ কাকের ভয়ে ভীত থাকে; রাতের বেলা কামে প্রীত হয়। এই চর্যা কুক্কুরীপার দ্বারা গাওয়া হয়; যা এককোটির মধ্যে একজনের চিত্তে তা প্রবেশ করে।(আরও দেখুন)

চর্য্যা ৩।।বিরুবাপা।

এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ॥
সহজে থির করি বারুণী সান্ধ।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধ॥
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিআ।
আইল গরাহক অপণে বহিআ॥
চউশটি ঘড়িয়ে দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা॥
এক সে ঘড়লী সরুই নাল।(চর্যাপদ কি)
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল॥

 ব্যাখ্যা: এক শুঁড়িনী দুই ঘরে ঢোকে–সে চিকন বাকল দিয়ে বারুণী মদ বাঁধে। সহজভাবে বারুণীতে প্রবেশ করো; যাতে দৃঢ় স্কন্দ লাভ করে অমর হতে পারে। শুঁড়ির ঘরের চিহ্ন দেখে গ্রাহক নিজে সেই পথ বেয়ে চলে আসে। চৌষট্টিটি ঘটিতে মদ ঢালা হয়েছে। গ্রাহক যে ঘরে ঢুকেছে কোনো সাড়া নেই; কারণ তার মধ্যে মদের নেশা ঢুকেছে। সরু নাল দিয়ে একটি ঘড়ায় মদ ঢালা হচ্ছে। বিরুপা বলেছেন চাল স্থীর করে মদ ঢালতে।(আরও দেখুন)

চর্যাপদ ৪।।গুণ্ডরীপা।

তিঅড়া চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী।
কমলকুলিশ ঘাণ্টে করহুঁ বিআলী॥
জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি॥
খেপহুঁ জোইনি লেপ ন জায়।
মণিকুলে বহিআ ওড়িআণে সমাঅ॥
সাসু ঘরেঁ ঘালি কোঞ্চা তাল।
চান্দসুজবেণি পখা ফাল॥
ভণই গুণ্ডরী অম্‌হে কুন্দুরে চীরা।
নরঅ নারী মাঝেঁ উভিল চীরা॥

 ব্যাখ্যা: আবেগের ব্যাকুলতায় যোগী লজ্জা ছাড়বেন; ঘৃণা ছাড়বেন; কলঙ্ককে করবেন অঙ্গের ভূষণ। উৎক্ষিপ্ত হতে লেপন করা যায় না। মণিকুল বেয়ে ঊর্ধ্বস্থানে প্রবেশ করো। শাশুড়ীর ঘরে তালা-চাবি রয়েছে। চন্দ্র-সূর্য্য দুই পাখা খন্ডন করো। গ্রাহ্য-গ্রাহক ভাব থাকলে মুক্তি পাবে না—তাই নির্বাণ লাভ করতে হলে এই দুটি ছাড়তে হবে।(আরও দেখুন)

চর্যাপদ কি

চর্যাপদ ৫।।চাটিলপা।

ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী॥
দামার্থে চাটিল সাঙ্কম গাঢ়ই।
পারগামি-লোঅ নিভর তরই॥
ফাড্ডিঅ মোহতরু পাটি জোড়িঅ।
অদঅ দিঢ় টাঙ্গী নিবাণে কোড়িঅ॥
সাঙ্কমত চড়িলে দাহিণ বাম মা হোহী।
নিয়ড্ডী বোহি দূর মা জাহী॥(চর্যাপদ কি)
জই তুম্‌হে লোঅ হে হোইব পারগামী।
পুচ্ছতু চাটিল অনুত্তর সামী॥

চর্যাপদের ব্যাখ্যা: ভবনদী গম্ভীরভাবে, সবেগে বয়ে চলেছে। কাঁদামাটির মাঝখানে পানিতে থই পাওয়া যায় না। এই ভবনদী পার হওয়ার জন্য চাটিলপা একটা সাঁকো তৈরী করে দিয়েছেন। যাদের ইচ্ছে এই সাঁকো পার হয়ে যেতে পারবে। যদি তোমরা পরগামী হতে চাও; তথাপি চাটিলপাকে জিজ্ঞেস করে সাঁকো পার হওয়ার কৌশল জেনে নাও।


আশাকরি “চর্যাপদ কি—বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ আর্টিকেলটি তোমাদের ভালো লেগেছে। আমাদের কোনো আপডেট মিস না করতে ফলো করতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেইজ


আরও দেখুন:মানুষ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা
আরও দেখুন:সেইদিন এই মাঠ কবিতার ব্যাখ্যা
আরও দেখুন:কপোতাক্ষনদ কবিতার ব্যাখ্যা
আরও দেখুন:সমাসের সহজ ব্যাখ্যা

আরও দেখুন: আনন্দধারা প্রশ্নোত্তর – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ১ম অধ্যায়
আরও দেখুন: শীত-প্রকৃতির রূপ সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ২য় অধ্যায়
আরও দেখুন: পলাশের রঙে রঙিন ভাষা সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৩য় অধ্যায়
আরও দেখুন: স্বাধীনতা তুমি সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৪র্থ অধ্যায়
আরও দেখুন: নব আনন্দে জাগো সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৫ম অধ্যায়
আরও দেখুন: আত্মার আত্মীয় সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৬ষ্ঠ অধ্যায়
আরও দেখুন: বৃষ্টি ধারায় বর্ষা আসে সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম অধ্যায়
আরও দেখুন: টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৮ম অধ্যায়
আরও দেখুন: শরৎ আসে মেঘের ভেলায় সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ৯ম অধ্যায়
আরও দেখুন: হেমন্ত রাঙা সোনা রঙে সমাধান – ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি ১০ম অধ্যায়

আরও দেখুন: বিশ্বজোড়া পাঠশালা – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ১ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: নকশা খুঁজি নকশা বুঝি – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ২য় অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: মায়ের মুখের মধুর ভাষা – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৩য় অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: স্বাধীনতা আমার – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৪র্থ অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: বৈচিত্র্যে ভরা বৈশাখ – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৫ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: কাজের মাঝে শিল্প খুঁজি – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৬ষ্ঠ অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: প্রাণ প্রকৃতি – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৭ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: প্রাণের গান – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৮ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: চিত্রলেখা – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ৯ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: শরৎ উৎসব – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ১০ম অধ্যায় সমাধান
আরও দেখুন: সোনা রোদের হাসি – শিল্প ও সংস্কৃতি ৭ম শ্রেণি ১১ অধ্যায় সমাধান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top